Saturday, 14 May 2016

ক্ষুধা ও অপুষ্টিমুক্ত বাংলাদেশ

ক্ষুধা ও অপুষ্টিমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে  সচেতনতা সাম্প্রতিককালে লক্ষণীয়। অতীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই লক্ষ্যে জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রতিষ্ঠা করে। সত্তরের দশক শেষ হওয়ার পর অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট অন্যতম। এ প্রতিষ্ঠানটি এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশকে ক্ষুধা ও অপুষ্টিমুক্ত করার লক্ষ্যে প্রায়োগিক গবেষণায় বর্তমানে লিপ্ত। এই প্রতিষ্ঠানের নতুন উদ্যোগের শিরোনাম হলো কমপ্যাক্ট-২০২৫। ২০১৫ সালে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। মালাউয়ি ও ইথিওপিয়ায় এ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি নীতিনির্ধারকদের জন্য গোলটেবিল বৈঠক ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ৫ মে ঢাকায় একই ধরনের গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের সুবিধার্থে একটি আলোচনাপত্রও প্রণীত হয়েছে। এতে স্বীকার করা হয় যে ১৯৯০-২০১৩ পর্যন্ত সময়ে দারিদ্র্য ও অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রে এ দেশে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও এ দুটি সমস্যা এখনো বিদ্যমান। এ ধরনের মতামতের ভিত্তি হলো ২০১৪ সালের জাতীয় জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমন্বিত বসতবাড়িবিষয়ক জরিপ প্রতিবেদন। এ দুটি সমস্যার বিষয়ে বলা হয় যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এ দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে। দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান হলো, ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সালে দরিদ্র ব্যক্তির হার ৬৩ থেকে ৪৪ শতাংশে হ্রাস পায়। দারিদ্র্যসীমার মাপকাঠি হলো মাথাপিছু ১.৯০ ডলার। অর্থাৎ এখনো মোট ৫৬ শতাংশ জনমানুষ এই মাপকাঠি অনুযায়ী দারিদ্র্য বা দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে।
দারিদ্র্যের মাত্রা হ্রাসের জন্য টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও ৫.৭ শতাংশ ছিল। এ পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাংকের। ১৯৯০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অক্ষুণ্ন ছিল। এর ফলে মাথাপিছু আয় ৮৪৮ থেকে তিন হাজার ২৭১ ডলারে উন্নীত হয়। তবে এই পরিমাণ দক্ষিণ এশিয়ার গড় মাথাপিছু আয়ের তুলনায় যথেষ্ট নয়। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের গড় মাথাপিছু আয় চার হাজার ৮০৭ ডলার। আলোচনাপত্রে বলা হয়, কৃষি খাতে ২০০৮-১২ সালে সরকারি বিনিয়োগ ৯ শতাংশ ছিল, যা বিশ্বের সব দেশের তুলনায় তৃতীয় বৃহত্তম। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের তুলনায় বিনিয়োগের পরিমাণ একেবারে মন্দ বা খুব কম ছিল না। তবে কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ যথেষ্ট হয়নি মর্মে মত প্রকাশ করা হয়। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির হার দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের তুলনায় বেশি। ২০০৭-১৪ সালে বাংলাদেশ এই হার ছিল ৪.৪। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের হার ৩.৩। এ পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাংকের। কৃষি গবেষণা খাতে বিনিয়োগের অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার বিষয়টি অতীতেও ছিল। তবে সাম্প্রতিককালে এই মাত্রা বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি অনেকে করে থাকেন তা হলো, গবেষণার ফলাফল যদি কৃষকরা কাজে লাগাতে না পারে, তাহলে বিনিয়োগ নিষ্ফল হয়। এ বিষয়ে আরো মনোযোগী হওয়ার অবকাশ রয়েছে।
গোলটেবিল আলোচনার অন্য বিষয়টি ছিল খাদ্য নিরাপত্তা। খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে অপুষ্টির বিষয়টিও জড়িত। এ বিষয়টি উপেক্ষা করে প্রকৃত অর্থে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ফলপ্রসূ হয় না। তবে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতির বিষয়ে আলোচনাপত্রে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৯০-৯২ থেকে ২০১৪-১৬ সালে অপুষ্টির হার অর্ধেকে হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ অপুষ্টির হার ৩২.৮ থেকে ১৬.৪ শতাংশ হ্রাস অর্জিত হয়েছে। এটি শুভ লক্ষণ, তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্ট নয়। অর্জিত হার ১০ শতাংশের নিচে থাকা বাঞ্ছনীয়। খাদ্যশস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসার দাবি রাখে। চাল উৎপাদন ২০০০-১৪ সালে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে শাকসবজির উৎপাদনের হার ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জমির উৎপাদন বৃদ্ধির হার চালের ক্ষেত্রে ২৭ শতাংশ এবং শাকসবজির ক্ষেত্রে ৬৩ শতাংশ। এর ফলে মাথাপিছু চালপ্রাপ্তি এক হাজার ৬৮৮ থেকে এক হাজার ৭১১ কিলোক্যালরি হয়েছে। শাকসবজির ক্ষেত্রে মাথাপিছু প্রাপ্তি ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের খাদ্যতালিকা ও অর্থনীতিতে মাছ উল্লেখযোগ্য। চাল ও শাকসবজির পর বাংলাদেশের খাদ্যতালিকায় মাছ অন্তর্ভুক্ত। ২০১৩ সালের এফএওর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশিদের জন্য ৫১ শতাংশ আমিষ মাছ থেকে পাওয়া যায়। ২০০০-১৪ সালে মাছ উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়। বর্তমানে মাছ উৎপাদন জিডিপিতে ৪.৪ শতাংশ অবদান রাখে। বেশি খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্যঘাটতি হ্রাস পেলেও এফএওর ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখনো জনপ্রতি ১১৬ কিলোক্যালরির ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি দূর করা না গেলে ক্ষুধা ও অপুষ্টি নির্মূল করা সম্ভব হবে না।
পুষ্টি অর্জনের ক্ষেত্রে গত দেড় দশকে যথেষ্ট সাফল্য হওয়া সত্ত্বেও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জও যথেষ্ট রয়েছে। ২০১৩ সালের এক আন্তর্জাতিক গবেষকের মতে, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের (বাংলাদেশসহ) ৪৫ শতাংশ শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ অপুষ্টি। শিশুদের অপুষ্টির অন্যতম লক্ষণ হলো খর্বাকৃতি। এর ফলে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির আশঙ্কার কথা অস্বীকার করা যায় না। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে খর্বাকার শিশুদের ক্ষেত্রে শিক্ষা অর্জনে বাধাসহ সাবালক হওয়ার পর কর্মক্ষমতাও হ্রাস পায়। সার্বিকভাবে জীবনযাপনের জন্য আয়ের ক্ষমতাও হ্রাস পায়। তবে ইউনেসকো, ডাব্লিউএইচও ও বিশ্বব্যাংকের ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর খর্বাকৃতির হার ছিল ৪৮ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ইফরির আলোচনাপত্রে বলা হয়েছে, অপুষ্টির অন্যান্য সূচকে মিশ্র দৃশ্যপট দেখা গেছে। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২৪ শতাংশ শিশুর বয়স অনুপাতে ওজন কম। ৩০ শতাংশ শিশুর ভিটামিনের ঘাটতি রয়েছে। জেলা পর্যায়ের চিত্রও অধিকতর তথ্য সংগ্রহের দাবি রাখে। খর্বাকৃতি শিশুর শতকরা হার সিলেট বিভাগে ৫০, বরিশালে ৪০ ও চট্টগ্রামে ৩৮। খুলনা বিভাগে এই হার সর্বনিম্ন। অথচ দারিদ্র্যপ্রবণ জেলায়ই অপুষ্টি অধিকতর হওয়ার কথা। খুলনা বিভাগে এই মাপকাঠিতে সে দৃশ্যপট দিচ্ছে না। এ বিষয়ে ইফরির আলোচনাপত্রে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা প্রণিধানযোগ্য। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে এ ধরনের বিপরীতধর্মী দৃশ্যপটের কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কৃষি খাতের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত সূচক অনুযায়ী সিলেট বিভাগের অবস্থান নিম্নে। মাত্র ১১ শতাংশ নারী এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হিসেবে চিহ্নিত। চট্টগ্রামে এই হার ১২ শতাংশ। অথচ এ দুটি বিভাগই ধনী এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির অন্যতম কারণ অপুষ্টি। উন্নয়নশীল দেশের জন্য অপুষ্টির কারণে জিডিপি প্রতিবছর ২ থেকে ৩ শতাংশ হ্রাস পায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে এ কারণে উৎপাদন হ্রাসের মাত্রা বছরপ্রতি সাত হাজার কোটি টাকা বা এক বিলিয়ন ডলার। স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত ব্যয় যোগ করলে এই হিসাব বৃদ্ধি পাবে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে অপুষ্টি নিরসনের অন্যতম উপায় হলো খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যের গুণগত মান। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশিদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা অতিমাত্রায় খাদ্যশস্যনির্ভর—মূলত চাল। শিশুদের খাদ্যতালিকার বৈচিত্র্য ও গুণগত মান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মাত্র ২৫ শতাংশ শিশু এ বিষয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও মানসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণে সক্ষম। গ্রামের শিশুদের ৭১ শতাংশ ক্যালরি চালনির্ভর। সাম্প্র্রতিককালে ফলসহ শাকসবজির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেলেও তা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের গড় প্রাপ্যতার তুলনায় কম। অপুষ্টি প্রতিরোধের জন্য অন্য কিছু ক্ষেত্রও অবদান রাখতে পারে; যেমন—বিশুদ্ধ পানিসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক অবকাঠামো। এ ছাড়া রয়েছে পরিবারের মা-বাবার শিক্ষাগত মান। এ আলোচনায় একজন নির্ধারিত গবেষক অপুষ্টি প্রতিরোধের জন্য দুটি সামাজিক সমস্যা সমাধানের বিষয় উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, এই দুটি সমস্যাই পুষ্টি অর্জনের ক্ষেত্রে সামাজিক বাধা। এক, বাল্যবিবাহ। জানা যায়, এ দেশের ৬৫ শতাংশ মেয়ে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে করে বা করতে বাধ্য হয়। দুই, নারীদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ, যার ফলে কর্মক্ষম নারীরা দুস্থ জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। এসব বিষয় আমলে নিয়ে ক্ষুধা ও অপুষ্টিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2016/05/15/358483#sthash.LXQFYV9O.dpuf

No comments:

Post a Comment